বিশ্বের ক্রিকেট খেলে
যাওয়া দেশগুলোর মাঝে এক দিবসীয় ক্রিকেট বিশ্বকাপ প্রতি চারবছর পর পর নিয়ে আসে
প্রবল উত্তেজনার অনির্বান রসদ যা সমাপ্ত হয় ফাইনাল ম্যাচের মাধ্যমে। অন্যান্য
ক্রিকেট খেলিয়ে দেশের চেয়ে এই উপমহাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা ছাপিয়ে যায় সব
কিছুতেই। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং আধুনা কালের আফগানিস্তান থেকে কোন অংশে
কম ক্রিকেট জরে আক্রান্ত নয় আমাদের বাংলাদেশের মানুষ। ১৯৭৫ সালের সাদা পোশাকে ৬০
ওভারের লাল বলে খেলার মধ্যে দিয়ে শুরু হওয়া ক্রিকেট বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ছয়টি
টেস্ট খেলিয়ে দেশের সাথে শ্রিলঙ্কা এবং পূর্ব আফ্রিকা। সেখান থেকে আজকের আধুনিক এক
দিবসীয় ক্রিকেট কুলীন সে পোশাক ছেড়ে পড়েছে রঙ্গীন পোশাক, দলের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে
১৪টি আর সাদা বলের সাথে উন্নত ক্যামেরা প্রযুক্তি খেলার খুঁটিনাটি নিয়ে এসেছে
মানুষের ঘরে টেলিভিশনের পর্দায়, কোন কিছুই আর নজর এড়াচ্ছে না। উত্তেজনার রসদ চারদিকে পসরা সাজিয়ে বসেছে আগামী
দেড়মাস ক্রিকেট আমোদীদের ব্যস্তিব্যস্ত রাখতে। সবার মনে প্রশ্ন কে জিতবে
শ্রেষ্ঠত্বের আসনে। প্রথম বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিল দোর্দন্ড প্রতাপশালী
ওয়েস্টইন্ডিজ যা তারে ধরে রেখেছিল ১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপেও। কিন্তু ১৯৮৩ সালের
বিশ্বকাপে কপিল দেব এর ভারত সবাইকে চমকে দিয়ে ছিনিয়ে নিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বকাপ। ১৯৮৭
সালের চতুর্থ বিশ্বকাপ এ উপমহাদেশের মাটিতে চমকে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া চ্যাম্পিয়ান
হয়ে যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল মূলত অস্ট্রেলিয়ার স্বর্নযুগ। ১৯৯২ সালে সব হিসেবের
বাইরে থেকে এসে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে শুরুতে ধুকতে থাকা ইমরান খানের পাকিস্তান জিতে
নিয়েছিল বিশ্বকাপ। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ বিশ্বকাপে আবির্ভাব হয়েছিল এক বদলে যাওয়া
শ্রীলঙ্কা, অর্জুনা রানাতুঙ্গার নেতৃত্বে হয়েছিল বিশ্বজয়ী। ১৯৯৯ সালের সপ্তম, ২০০৩
সালের অষ্টম এবং ২০০৭ সালের নবম শিরোপা জিতে অস্ট্রেলিয়া বজায় রেখেছিল বিশ্ব
ক্রিকেটে তাঁদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ভারতীয় উপমহাদেশের মাটিতে দশম বিশ্বকাপে শিরোপা
ফিরে এসেছিল ভারতের কাছে। এ পর্যন্ত দশটি বিশ্বকাপে টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মাঝে
বিশ্বকাপ এখনো অধরা রয়ে গেছে ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, বাংলাদেশ আর
জিম্বাবুয়ের কাছে। বাস্তবিক অবস্থায় বাংলাদেশ বা জিম্বাবুয় ক্রিকেটীয় মানে খানিকটা
পিছিয়ে থাকলেও অন্য চারটি দেশ কাছাকাছি গিয়ে আক্ষেপে পুড়েছে অনেকবার।
এবার যদি আসি এই ২০১৫
সালের একাদশ বিশ্বকাপের কথায় তবে সবার মনেই উৎকণ্ঠা, প্রশ্ন কে জিতবে শিরোপা? আর
বাংলাদেশে কতটুকু যেতে পারবে? গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে পূর্ব অনুমান করাটা
খুব কষ্টসাধ্য তবে তথ্য, উপাত্ত, ভেন্যু আর সমসাময়িক পারফর্মেন্সের উপর নির্ভর করে
অনেক কিছুই বলা যায় যার কিছুটা হয়তো মিলে যাবে বিশ্বকাপের শেষদিনে।
কে যাবে ফাইনালেঃ
বর্তমান ওডিআই র্যাঙ্কিং
এ শির্ষে থাকা অস্ট্রেলিয়া আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ান ভারতের
মাঝেই বিশ্বকাপ এর ফাইনাল হবার সম্ভাবনার পাল্লাই সবচেয়ে ভারী। দুটি দলই সেরা
খেলোয়াড়দের ইনজুরি নিয়ে একটু সমস্যায় থাকলেও একাধিক বারের বিশ্বকাপ জেতার অভিজ্ঞতা
তাঁদের পাল্লা ভারি করেছে নিশ্চিয়। নিজের মাটিতে এবারের বিশ্বকাপে চার চার বারের
চ্যাম্পিয়ান অস্ট্রেলিয়া কাউকে এক ইঞ্চি স্থান ছাড়বেনা একথা নিশ্চিতই বলা যায়,
তাঁর সাথে সাম্প্রতিক কালের ফর্ম বিবেচনা করলে তারা এ দৌড়ে এগিয়ে রয়েছে অন্যসবার
চেয়ে। অপরদিকে অফফর্মের বোলিং নিয়ে ভারত একটু পিছিয়ে থাকলেও ম্যাচ উইনিং
ব্যাটসম্যানদের পাল্লাটা তাঁদের দিকেই সবচেয়ে ভারী। বিশাল লাইন আপের ভারতীয়
ব্যাটিং লাইন তাঁর দিনে দুমড়ে মুচোড়ে দিতে পারে বিশ্বের যে কোন বোলিং কে। সাম্প্রতিককালে
একটু বাজে সম্নয় গেলেও ভারত নিশ্চয়ই চোখ রেখেছে তাঁদের শিরোপা ধরের রাখবার জন্য।
এর বাইরে ফাইনালে যাবার সম্ভাবনায় অন্য দলগুলোর থেকে খানিকটা এগিয়ে আছে সাউথ
আফ্রিকা, শ্রীলঙ্কা, ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। সাউথ আফ্রিকা সাম্প্রতিককালে খেলছে
দুর্দান্ত ক্রিকেট, দুর্দান্ত ব্যাটিং লাইনআপ আর কার্যকরি বোলিং শক্তি তাঁদের
বিশ্বকাপ শিরোপার দাবীদার নিশ্চিতভাবেই করেছে শুধু অতীতের চোকার বদনামটা ঘোচাতে
হবে। অন্যদিকে অভিজ্ঞ শীলঙ্কান ব্যাটিং লাইনআপ বিজয় ছিনিয়ে নিতে সক্ষম যে কোন দলের
বিপক্ষেই, আবার ইংল্যান্ড তাঁদের দুর্দান্ত বোলিং আক্রমন নিয়ে দাবী করতেই পারে
ফাইনাল এ যাবার। আরেকটি দল নিউজিল্যান্ড যারা বিশ্বকাপ আসলে বরাবর খেলে এসেছে
দুর্দান্ত, তাঁর মাঝে এবার নিজের মাটিতে তাই তাঁদের ব্যাটিং শক্তি আর চেনা পরিবেশ
নিয়ে আসতে পারে অধরা সাফল্য।
বাকি দলগুলোর মধ্যে
অনেকবার অসম্ভব কে সম্ভব করা পাকিস্তান ছন্দে ফিরলে সেমিফাইনাল পর্যন্ত চলেও আসতে
পারে আর সে যদি আসেই তবে হয়তো দূর্দান্ত ভাবে চলে যাবে ফাইনালে, বর্তমান ক্রিকেটে
এই একটি দল নিয়ে কিছু বলা বেশ কঠনই বটে। প্রথম দুই বিশ্বকাপ জেতা এককালের প্রবল
পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজ আজ নিজেকে হারিয়ে খুঁজে ফিরিছে এর সাথে যোগ হয়েছে খেলোয়াড়
আর বোর্ডের মাঝে দন্দ্ব। এহেন পরিস্থিতিতে তাঁদের নিয়ে বাজি ধরতে খুব কম লোকই
যাবেন। অন্য দুটি টেস্ট খেলুড়ে দেশের মাঝে অনেক পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ গিয়েছে এ
বিশ্বকাপে তাঁদের আগের পারফর্মেন্সের উন্নতি ঘটাতে তাই আফগানিস্তান আর
স্কটল্যান্ডের সাথে দু একটি বড় দেশকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়াটাই
বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বাউন্সি এবং দ্রুত উইকেটে
ব্যাটসম্যানদের নিংড়ে দিতে হবে নিজেদের কাঙ্খিত সাফল্য পেতে। অন্যদল জিম্বাবুয়ে
তাঁর অতিতের ছায়া হয়ে আছে, নানা সমস্যায় জর্জরিত এ দল একইভাবে লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছে
আয়ারল্যান্ড আর দুর্বল আরব আমিরাত এর সাথে দু একটা অঘটন ঘটিয়ে কোয়ার্টার ফাইনাল
পর্যন্ত যাবার। বাকি দলগুলোর মধ্যে আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর আফগানিস্তান প্রায়
নিয়মিত অঘটন ঘটিয়েছে আগে তাই একথা আশাই করা যায় বড় দুএকটি দলকে হারিয়ে চমকে দেবার
সাথে সাথে বিশ্বকাপকে জমিয়ে তুলতে তারা ভালোই ভুমিকা রাখবে। এদের সবার চাইতে আরব
আমিরাত অনেক পিছিয়ে আছে নিশ্চিত।
ইতিমধ্য সবকটি দোলে
অস্ট্রেলিয়ায় পৌছে নিবিড় অনুশীলন আর প্রস্তুতি ম্যাচের মাধ্যমে ঝালিয়ে নিচ্ছে
নিজেদের। আর মাত্র দুদিন পর ক্রাইস্টচার্চের হেইগলে ওভালে শ্রীলঙ্কা আর
নিউজিল্যান্ডের মাঝে লড়াই দিয়ে পর্দা উঠছে একাদশ বিশ্বকাপ এর লড়াই এর যা শেষ হবে
২৯ মার্চ এর রাতে, হয়তো বিশ্বকাপ দেখপবে নতুন কোন চ্যাম্পিয়ন, আমরা সেই অপেক্ষায়
রইলাম। তারসাথে শুভকামনা থাকলো আমাদের বাংলাদেশের জন্য।
-
আলী ওয়াসিকুজ্জামান অনি
ক্রিকেট কোচ ও সাবেক
ক্রিকেটার
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন